টিন সার্টিফিকেট (TIN Certificate) শব্দটি বর্তমানে বাংলাদেশে নিয়মিত করদাতাসহ প্রায় সকলের কাছে খুবই পরিচিত। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রেই আমাদের টিন সার্টিফিকেট ও টিন নাম্বারের প্রয়োজন পড়ে। তাই আয় করেন এমন প্রত্যেক নাগরিকের জন্য অবশ্যই নিজস্ব টিন/ টিআইএন (TIN) সার্টিফিকেট থাকা আবশ্যক। আবার অনেকের এ টিন সার্টিফিকেটটি কিভাবে করবেন ভেবে কুল পান না। তাই আজকের পর্বটি যারা এখনও টিন সার্টিফিকেট কিভাবে করতে হয় তা অবগত নন শুধুমাত্র তাদের জন্য।
টিন(TIN) বা ই-টিন(E-TIN) সার্টিফিকেট কি?
বাংলাদেশে আয়কর রিটার্ন দেওযার সময় হচ্ছে অক্টোবর ও নভেম্বর মাস। প্রত্যেক করদাতার একটি করে ই-টিন বা ই-টিআইএন থাকে। টিন/টিআইএন (TIN) এর পূর্ণরূপ হচ্ছে ট্যাক্সপেয়ার আইডেনটিফিকেশন নম্বর (Taxpayer Identification Number)। আর ই-টিন (E-TIN) হলো আয়কর নিবন্ধনের ডিজিটাল সংস্করন। টিন নাম্বারটি সাধারনত ১২ সংখ্যার একটি বিশেষ নাম্বার যা সংশ্লিষ্ট কর অফিস প্রদান করে থাকে। এর প্রথম তিনটি সংখ্যা করদাতার অঞ্চল, মাঝের তিনটি সংখ্যা করদাতার পদমর্যাদা এবং শেষ চারটি দ্বারা করদাতাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়। অর্থাৎ টিআইএন বা টিন সার্টিফিকেট হচ্ছে একজন করদাতার পরিচয়পত্র।
টিন(TIN) বা ই-টিন(E-TIN) কীভাবে করবেন?
ই-টিআইএন নেওয়ার জন্য আপনাকে আয়কর অফিসে যেতে হবে না। আপনি ঘরে বসে অনলাইনেই ই-টিআইএন পেতে পারেন। তাছাড়া ই-টিআইএন করার জন্য কোনো টাকা লাগে না। এনবিআর বিনা মূল্যে ই-টিআইএন ইস্যু করে থাকে।
টিন(TIN) বা ই-টিন(e-TIN) সার্টিফিকেট কি কাজে লাগে?
বর্তমানে বাংলাদেশে টিন সার্টিফিকেট এর ব্যবহার যথেষ্ট বেড়ে গেছে। চাকুরী, ব্যবসা থেকে শুরু করে মুক্ত পেশাজীবি হিসেবেও টিন সার্টিফিকেট আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে টিন সার্টিফিকেট অন্যান্য সার্টিফিকেট বা লাইসেন্স পেতেও ব্যবহার হয়। নীচে টিন সার্টিফিকেট কোন কোন কাজে ব্যবহৃত হয় তার তালিকা উপস্থাপন করা হলো।
১. কোন ব্যবসা শুরু করতে ট্রেড লাইসেন্স নিতে।
২. কোন ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে।
৩. নতুন গাড়ির মালিক হতে বা মালিকানা পরিবর্তন করতে।
৪. সিটি কর্পোরেশনের এলাকার কোন জমি, ভবন বা ফ্ল্যাট রেজিষ্ট্রেশন করতে।
৫. কোন ব্যাংক থেকে ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার আবেদন করলে।
৬. কোনো কোম্পানির শেয়ার কিনতে।
৭. নিজের কোম্পানি নিবন্ধন করতে।
৮. বিদেশ থেকে কোন পণ্য আমদানি করার ক্ষেত্রে আমদানিপত্র রেজিস্ট্রেশন করতে।
৯. মুক্ত পেশাজীবী হিসেবে (হিসাবরক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলীদের) পেশার চর্চা করতে।
১০. যেকোন ধরনের নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহন করতে চাইলে।
১১. কোন ব্যবসায়িক সমিতি অথবা ব্যবসায়ীদের কোন নিবন্ধিত সংগঠনের সদস্য হতে।
১২. রাইড শেয়ারিং কোম্পানিতে গাড়ি দিতে।
১৩. বিভিন্ন সরকারি, আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার দরপত্রে অংশ নিতে।
কাদের টিন(TIN) বা ই-টিন(e-TIN) সার্টিফিকেট প্রয়োজন হবে?
কর পরিশোধ করার নিয়ম বাংলাদেশ সহ বিশ্বের সকল দেশেই রয়েছে। যাদের সরকারের নির্ধারিত নির্দিষ্ট বাৎসরিক আয় আছে তাঁদেরকে অবশ্যই সরকারকে কর দিতে হবে। অর্থাৎ যাদের কর যোগ্য আয় রয়েছে তাঁরা সকলেই টিন সার্টিফিকেট করতে পারবেন।
যাদের উপর আয়কর প্রযোজ্য হবে তার তালিকাঃ
১) বাৎসরিক আয় ৩,০০,০০০ (তিন লক্ষ) টাকার উর্ধ্বে হলে।
২) কোন মহিলার বয়স ৬৫ বছরের উর্ধ্বে এবং বাৎসরিক আয় ৩,৫০,০০০ (তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার) টাকার উর্ধ্বে হলে।
আয়কর প্রদান করা ছাড়াও অনেকের আরো বিভিন্ন বিষয়ের জন্য কর প্রদান করার প্রয়োজন হতে পারে। তাই করদাতাকে টিন সার্টিফিকেট তৈরি করে নিতে হবে। আবার কর প্রদানের প্রয়োজন ছাড়াও অনেকের টিন সার্টিফিকেট তৈরীর প্রয়োজন হতে পারে।
এখানে যে সকল পেশাজীবি ব্যক্তিদের টিন সার্টিফিকেট প্রয়োজন হতে পারে তাদের তালিকা উপস্থাপন করা হলোঃ
১) নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ট্রেড লাইসেন্স থাকলে।
২) গাড়ির মালিক হলে।
৩) ভ্যাট (VAT) বা মূল্য সংযোজন কর আইন-১৯৯১ অনুযায়ী কোন ক্লাবের সদস্যপদ থাকলে।
৪) ব্যবসার উদ্দেশ্যে বিদেশি পন্য আমদানিকারক হলে।
৫) যেকোন নির্বাচনে প্রার্থী হলে।
৬) কোন নিবন্ধিত ব্যবসায়িক সংগঠনে সদস্যপদ থাকলে।
৭) মুক্ত পেশায় (যেমন-হিসাবরক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ইত্যাদি) নিয়োজিত থাকলে।
৮) ব্যাংক-এর ক্রেডিট কার্ড পেতে হলে।
৯) সরকারী, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের দরপত্রে অংশগ্রহনকারী ব্যক্তিদের।
টিন(TIN) বা ই-টিন(e-TIN) সার্টিফিকেট করতে কি কি ডকুমেন্ট লাগে? (Documents for e-TIN Certificate)
টিন(TIN) সার্টিফিকেট তৈরি করার জন্য আপনাকে প্রথমে প্রয়োজনীয় সকল তথ্য ও কাগজপত্র সংগ্রহ করে রাখতে হবে। নিচের তালিকা হতে টিন সার্টিফিকেট তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো জেনে নিন।
১) আবেদনকারীর NID কার্ড ও NID কার্ডের নাম্বার
২) আবেদনকারীর নাম (NID কার্ড অনুযায়ী)
৩) আবেদনকারীর পিতা ও মাতার নাম
৪) আবেদনকারীর স্বামী অথবা স্ত্রীর নাম (Optional)
৫) আবেদনকারীর বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা
ই-টিন (E-TIN) সার্টিফিকেট করার নিয়ম (ধাপসমূহ) (Steps of e-TIN Registration)
টিন সার্টিফিকেট অনলাইনে তৈরির ডিজিটাল সংস্করন হচ্ছে ই-টিন। যার মাধ্যমে আবেদনকারীর সকল তথ্যগুলো অনলাইনে সংরক্ষিত থাকে। বর্তমানে এ ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে পুরাতন টিন সার্টিফিকেটগুলোকেও ই-টিনে রূপান্তর করা হয়েছে এবং হচ্ছে। অনলাইনে ই-টিন সার্টিফিকেট তৈরি করার প্রক্রিয়াটি খুব সহজ। কিভাবে অনলাইনে টিন সার্টিফিকেট সহজে তৈরী করা যায় নিচের পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করলে জানতে পারবেন।
ধাপঃ১
=> নতুন পদ্ধতিতে ই-টিআইএন রেজিস্ট্রেশন ও রি-রেজিস্ট্রেশন করার জন্য প্রথমে আপনাকে একটি ইউজার একাউন্ট তৈরী করে নিতে হবে। একাউন্ট তৈরীর জন্য এখানে ক্লিক করে ওয়েবসাইটটে প্রবেশ করে নিন।
=> ওয়েবসাইটের হোমপেজ থেকে ‘Register’ বাটনে ক্লিক করলে নিচের চিত্রের মত টিআইএন সার্টিফিকেট রেজিস্ট্রেশন করার অনলাইন ফরমটি ওপেন হবে।
ধাপঃ২
এ অনলাইন ফরমটি পূরন করার মাধ্যমে ইউজার একাউন্ট তৈরী করতে হবে। এজন্য ফরম এর প্রতিটি অংশ অবশ্যই ইংরেজিতে পূরন করতে হবে।
=> সবার প্রথমে ইউজার আইডি (User ID) এর খালি ঘরে নিজের একটি সংক্ষিপ্ত নাম দিন।
=> পাসওয়ার্ড (Password) এর ঘরে ৮ অক্ষরের যে কোন একটি পাসওয়ার্ড দিন। (অবশ্যই মনে রাখতে হবে। প্রয়োজনে নোট করে রাখুন।)
=> রিটাইপ পাসওয়ার্ড (Retype Password) এর ঘরে পুন:রায় পাসওয়ার্ডটি দিন।
=> Security Question এর ঘরে যে কোন একটি প্রশ্ন অবশ্যই সিলেক্ট করে নিতে হবে। এটি আইডি’র অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্য।
=> Security Question এর উত্তর দিন। (অবশ্যই মনে রাখতে হবে। প্রয়োজনে নোট করে রাখুন।)
=> Country এর ঘরে দেশের নাম নির্বাচন করতে হবে।
=> Mobile এর ঘরে আপনার সচল থাকে এমন একটি মোবাইল নাম্বার লিখতে হবে।
=> Email Address এর ঘরে আপনার ই-মেইল এড্রেসটি দিন (আবশ্যক নয়)।
=> Verification Letters এর ঘরে ক্যাপচাটি ঠিকমত বসিয়ে দিন।
=> এর পর Register বাটনে ক্লিক করুন।
ধাপঃ৩
=> Register বাটনে ক্লিক করার পর মোবাইল ভেরিফিকেশন এর জন্য এসএমএস এর মাধ্যমে একটি কোড মোবাইলে যাবে।
=> কোডটি e-TIN Activation Code এর ঘরে টাইপ করে বসিয়ে দিন।
=> এরপর Activate বাটনটিতে ক্লিক করুন।
Activate বাটনটিতে ক্লিক করার সাথে সাথেই নিচের চিত্রের মত আপনার ই-টিন রেজিস্ট্রেশন (e-TIN Registration) সম্পন্ন হয়েছে এবং নতুন করে লগইন করার অনুরোধ করে একটি ম্যাসেজ স্ক্রিনে দেখাবে।
=> নতুন করে লগইন করার জন্য উপরের ট্যাব থেকে লগ ইন অপশনটিতে ক্লিক করুন। যা উপরের চিত্রের মাধ্যমে মার্ক করে দেখানো আছে।
=> লগইন বাটনে ক্লিক করার সাথে সাথে আপনি আপনার আইডি এর হোমস্ক্রিন এ চলে যাবেন।
ধাপঃ৫
=> লগইন করার পর ইউজার এর হোমস্ক্রিন হতে বাম পাশের তালিকা হতে TIN Application বাটনে ক্লিক করতে হবে।
=> এখন Taxpayer's Status / করদাতার ধরন (a) এর ঘরে ব্যক্তিগত টিন এর জন্য “Individual” এবং কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য হলে প্রতিষ্ঠানের ধরন অনুযায়ী “Company” অথবা “Partnership firm” নির্বাচন করুন।
=> Taxpayer's Status / করদাতার ধরন (b) এর ঘরে আপনি কোন ধরনের আইডি দিতে চান সেটি সিলেক্ট করুন। এখানে এনআইডি, ট্রেড লাইসেন্স সহ অন্যান্য আইডিও হতে পারে।
=> Registration Type / রেজিস্ট্রেশন ধরন এর ঘরে নতুন রেজিষ্ট্রেশন করার জন্য New Registration নির্বাচন করুন।
=> এরপর আপনার আয়ের উৎস সম্পর্কিত অন্যান্য তথ্যগুলো প্রতিটি ঘরে সঠিকভাবে প্রদান করুন।
=> সবকিছু পূরন হয়ে গেলে Go to next অপশনটিতে ক্লিক করুন।
ধাপঃ৬
=> এরপর ব্যক্তিগত মৌলিক তথ্য প্রদানের ফরমটি স্ক্রিনে আসবে।
=> এর পরে আপনি স্ক্রিনে Final Prieview পেজটি দেখাবে।
=> এখানে আপনার দেওয়া তথ্যগুলোর সম্পূর্ন প্রিভিউ দেখতে পাবেন। এখানেই আপনাকে টিন সার্টিফিকেট যাচাই করে নিতে হবে। যদি কোন তথ্য ভুল থাকে তাহলে সঠিক করার জন্য Back to Previous বাটনে ক্লিক করে ফেরত যেতে হবে।
=> যদি সব তথ্য সঠিক থাকে তাহলে ‘উপরের সকল তথ্য সঠিক ও সম্পূর্ণ এবং আমার অন্য কোন টিন সার্টিফিকেট নেই’ বাক্যের পাশে ছোট খালি বক্সে ক্লিক করে টিক চিহ্ন দিন।
=> Submit Application এ ক্লিক করুন।
ধাপঃ৭
=> ৬ নং ধাপটি সম্পন্ন করার সাথে সাথে আপনার ই-টিন সার্টিফিকেটের আবেদন করা সম্পন্ন হয়ে যাবে।
=> এরপর যে পেজটি স্ক্রিনে আসবে সেখানে আপনার বিভিন্ন ধাপে দেওয়া তথ্য এবং এনআইডি কার্ড থেকে নেওয়া তথ্য নিয়ে আপনার ছবি সহ সকল তথ্য প্রদর্শিত হবে। এটিই হচ্ছে আপনার ই-টিন।
=> পেজটির নীচে View Certificate এর মাধ্যমে আপনার টিন সার্টিফিকেটটি দেখতে পারবেন এবং Print Details এর মাধ্যমে টিন সার্টিফিকেট ডাউনলোড ও প্রিন্ট নিতে পারবেন।
ই-টিন সার্টিফিকেট এর নমুনা |
টিন(TIN) সার্টিফিকেটের সুবিধাগুলো কি কি?
বাংলাদেশের করদাতাদের সনাক্ত করা হচ্ছে টিন সার্টিফিকেটের মূল উদ্দেশ্য। টিন সার্টিফিকেটের মাধ্যমে ট্যাক্স দেওয়া ছাড়াও আরো অনেক ধরনের সুবিধা পাওয়া যায়।
যেমনঃ
১) সঞ্চয়পত্র তৈরি করা। বর্তমান রাজস্ব নিয়ম অনুযায়ী ২,০০,০০০ (২ লক্ষ) বা তার বেশী অঙ্কের টাকার সঞ্চয়পত্র করতে চাইলে সঞ্চয়পত্রকারীর অবশ্যই টিন সার্টিফিকেট থাকা আবশ্যক। এখানে উল্লেখ্য যে, টিন সার্টিফিকেট আবশ্যকতা থাকলেও কর দেওয়াটা বাধ্যতামূলক নয়।
২) নতুন গাড়ি কেনা ও রেজিষ্ট্রেশন করার জন্য টিন সার্টিফিকেট আবশ্যক।
৩) আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবসা হলে নতুন ট্রেড লাইসেন্স করা বা নবায়ন করার জন্য টিন সার্টিফিকেট আবশ্যক।
শেষকথা
কর পরিশোধ করা যেমন একজন সুনাগরিকের দায়িত্ব। তেমনি কর পরিশোধ করার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো টিন সার্টিফিকেট তৈরি। বাংলাদেশের আয়কর ব্যবস্থা ডিজিটালাইজড হওয়ার সুবাদে আপনি ঘবে বসে আপনার টিন(TIN) সার্টিফিকেট তৈরী করতে পারবেন। ই-টিন রেজিস্ট্রেশন করে কিভাবে সার্টিফিকেট ডাউনলোড ও প্রিন্ট করতে হয় তা বিস্তারিত উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। তবুও যদি কোথাও বুঝতে সমস্যা হয় তাহলে কমেন্ট করে জানানোর অনুরোধ রইল।